রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০০৮

সংস্কৃতি প্রত্যয়টি আমরা কি করে পেলাম

অনুঘটক পত্রিকার আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো আবুল কাসেম ফজলুল হক এর লেখা 'সংস্কৃতি আমাদের হারানো প্রত্যয়'। সংস্কৃতি কি, সংস্কৃতি বলতে কি বোঝায়, বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি বিষয়ক অনুধাবন কবে থেকে কিভাবে শুরু হলো, সংস্কৃতি বলতে আমরা বর্তমানে কি বুঝছি, আর সংস্কৃতি বলতে সত্যিকারের কোন বিষয়টাকে বোঝায় ইত্যাদি বিষয়গুলোর আলোচনা রয়েছে এই প্রবন্ধটিতে।

জানা যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বাংলাভাষায় সংস্কৃতি বিষয়ক ধারণার প্রথম প্রবর্তন ঘটে। ম্যাথু আর্নল্ডের (১৮২২-১৮৮৮) Culture and Anarchy বইটি পড়ে তিনি ইউরোপিয় কালচারের ধারণার সাথে পরিচিত হন। নতুন উপলব্ধিবোধে অনুপ্রাণিত বঙ্কিমচন্দ্র নিজেদের সংস্কৃতিবোধকে পুনর্গঠনের প্রেরণা অনুভব করেন। তাঁর আগে বাংলাভাষায় রচিত কোনকিছুতে সংস্কৃতি নিয়ে কারও ভাবনাচিন্তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। বঙ্কিমচন্দ্র ম্যাথু আর্নল্ডের পাশাপাশি বেন্থাম, স্টুয়ার্ট মিল, ডারউইন, স্পেন্সার, কোঁৎসহ বিভিন্ন ইউরোপিয় মনীষীর কাছ থেকে সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। আবুল কাসেম বলেছেন:
তবে কালচার বিষয়ক ধারণার কোনো উপাদানই যে আগে বাংলা ভাষায় ছিল না, তা নয়। রামপ্রসাদের গানে আছে: 'এমন মানবজমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা'। এখানে জীবনের যে আবাদের কথা বলা হয়ে তাকে কালচার বলা যায়। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস, সংযম, চিত্তশুদ্ধি, চিৎপ্রকর্ষ, সভ্যতা, সম্প্রীতি প্রেমধর্ম ইত্যাদি কথার মধ্যেও কালচারের ধারণা আছে।


উনিশ শতকের বাংলায় ইউরোপিয় দার্শনিকদের মধ্যে স্টুয়ার্ট মিল, অগাস্ট কোঁৎ ও চার্লস ডারউইনের প্রভাব সবচাইতে বেশি ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ম্যাথু আর্নল্ডের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন: '"যে শিশু দেখিতেছে, ইহা মনুষ্যের অঙ্কুর। বিহিত কর্ষণে অর্থাৎ অনুশীলনে উহা প্রকৃত মনুষত্ব প্রাপ্ত হইবে।" বঙ্কিমচন্দ্র যখন সংস্কৃতি বিষয়টিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলেন, সে সময়ে বাংলাভাষায় আর কারও মধ্যে এ সম্পর্কিত কোনরূপ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না। তাই বলা যায়, বাঙালিদের মধ্যে উনিশ শতকের শেষাংশর বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সংস্কৃতি সম্পর্কে চিন্তার সূত্রপাত।
বঙ্কিম অনুভব করেছিলেন যে, কালচার ধর্মের মতোই একটি গুরুতর ব্যাপার, তবে ধর্ম থেকে ভিন্ন। ম্যাথু আর্নল্ড লিখেছেন: The substance of religion is culture. বঙ্কিমচন্দ্র এর অনুসরণে লিখেছেন : 'মানববৃত্তির উৎকর্ষণেই ধর্ম।' এর ষাট বছর পরে মোতাহার হোসেন চৌধুরী লিখেছেন: "ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।"........ অনুশীলন (রচনাবলীতে ধর্মতত্ত্ব) গ্রন্থে বঙ্কিচন্দ্র মানুষের মনুষ্যত্ব অর্জনের সমস্যা, সম্ভাবনা ও উপায় আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর চিন্তা কেবল ব্যক্তিকে নিয়ে নয়, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজকে নিয়েও। ব্যক্তি তাঁর দৃষ্টিতে সমাজের অংশ। মানুষের সৃষ্টি সামর্থ্য ও তার সদ্ব্যবহার নিয়েও তিনি চিন্তা করেছেন। নীতিবিজ্ঞানের বিচারে বঙ্কিম উপযোগবাদী বা পরিতৃপ্তিবাদী (Utilitarianist), আত্মনিগ্রহবাদী (Austerist) নন।
প্রথমদিকে ১৮৮৮ সালে ধর্মের ধারণার সঙ্গে কালচারের ধারণার মিশ্রণ ঘটিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র অনুশীলন নামে একটি বই লিখেছিলেন। পরে বঙ্কিম রচনাবলীতে এই বইটি 'ধর্মতত্ত্ব' নামে সঙ্কলিত হয়। আবুল কাশেম মনে করেন:
অনুশীলন বাংলা ভাষার এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী গ্রন্থ। বাংলা ভাষার দেশে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এতে কেবল যে ব্যক্তিগত জীবনের কালচারের কথাই বলা হয়েছে, তা নয়; সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কালচারের কথাও এতে আছে। কালচার বা অনুশীলন ব্যাটারটা যে সৃষ্টিশীল, তাও বলা হয়েছে। এ গ্রন্থ আজকের দিনে বাংলাদেশের বাঙালিদের জন্য যেমন, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জন্যও তেমনি- গুরুত্বপূর্ণ ও প্রেরণাদায়ক। আজো এ গ্রন্থ আমাদেরকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে জীবনজগত সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে প্রাণিত করে।
উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রথমদিকে অনুশীলন শব্দটাকে 'কালচার' শব্দের সমার্থশব্দ হিসেবে বহুলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি 'কৃষ্টি' শব্দকে কালচারের সমার্থক হিসেবে প্রবর্তনের চেষ্টা চালান। ১৯২০ এর দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় সংস্কৃতি শব্দটিকে প্রচার করেন। প্রমথনাথ বিশীও এই প্রচেষ্টার অন্যতম অংশীদার ছিলেন। সে সময়ে এই 'কালচার' শব্দের যথাযথ বাংলা শব্দ কি হতে পারে সে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। 'কর্ষণ', 'চর্চা', 'শিক্ষা', 'বৈদগ্ধ্য', 'চরিত্র', ইত্যাদি শব্দকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই শব্দগুলোর মধ্যে বিভিন্ন অর্থবোধক পার্থক্যর পাশাপাশি পরস্পরের মধ্যে মর্মগত ধারণারও বেশ পার্থক্য ছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে তমদ্দুন মজলিশ 'সংস্কৃতি' শব্দের পরিবর্তে 'তমদ্দুন' বা 'তাহজিব' শব্দদ্বয় প্রচলনের একটি প্রচেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে সংস্কৃতি শব্দটি। তাহলেও কি হবে। প্রথমদিকে বঙ্কিচন্দ্র কালচার শব্দের মধ্যে যে বিশাল ধারণার সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন কালক্রমে সে ধারণার বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন সংস্কৃতি শব্দের ভাবার্থ আর ব্যাপক কোন ধারণাকে বহন করে না, বরং
অনেকাংশে সংকুচিত/ সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে।
ব্রিটেনে বেকন (১৫৬১-১৬২৬) থেকে, আমেরিকায় ইমার্সন (১৮০৩-১৮৮৩) থেকে এবং ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় বেকনের কাছাকাছি সময় থেকে কালচারের ধারণার ধারাবাহিক বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। বঙ্কিমের পরে ক্রমে ধারণাটি পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত হয়। বঙ্কিম থেকে পরবর্তী কালের বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চিন্তকেরা প্রত্যেকেই কালচার বা সংস্কৃতি সম্পর্কে চিন্তা করেছেন। তবে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চিন্তকেরা কালচার বা সংস্কৃতির ধারণাকে যেভাবে বিকশিত করেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচারমাধ্যম ধারণাটিকে তা থেকে বিচ্যুত করে অর্থের দিক দিয়ে একেবারে সঙ্কীর্ণ করে ফেলেছে। আজকের প্রচারমাধ্যম সংস্কৃতি বলতে বোঝায় নাচগান, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদি বিনোদনমূলক বিষয়কে। সংস্কৃতি ও বিনোদন এখন সমার্থক হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজও আজ ঔৎসুক্যহীন।
আমাদের দেশে সংস্কৃতি বিষয়ে যা হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসের বিপরীত পথে হেঁটেছে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় সংস্কৃতির ধারণাটি ক্রমশ বিকাশমান, কিন্তু আমাদের দেশে এই ধারণাটি ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে চলেছে। বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কিছু অসাধারণ চিন্তাপ্রদায়ী গ্রন্থ রচনা হয়েছে। যেমন: 'অনুশীলন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়', 'সংস্কৃতির রূপান্তর: গোপাল হালদার', 'কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতি: নীহাররঞ্জন রায়' ইত্যাদি। সংস্কৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, যোগেশচন্দ্র প্রমুখের ভাবনাগুলো রয়েছে তাদের বিভিন্ন প্রবন্ধে। এছাড়াও গত পঞ্চাশ বৎসরে আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, আব্দুল মতীন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার এবং আরও অনেক প্রাজ্ঞ চিন্তক সংস্কৃতি নিয়ে তাদের ধারণা ও উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন। পশ্চিম বাংলায় অন্নদাশঙ্কর রায়, নারায়ণ চৌধুরী, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত ও আরো অনেকে সংস্কৃতির স্বরূপ অন্বেষণে নিজস্ব মতামত প্রচার করেছেন। বস্তুত: গত সোয়াশো বৎসর ধরে বাংলাভাষার পণ্ডিতেরা সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার নিরন্তর প্রয়াস পেয়েছেন। আজকের দিনে সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে এদের দেখিয়ে দেয়া পথ ধরেই। তাদের চিন্তার ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতিকে অনুভব করতে হবে। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন:
সংস্কৃতির ধারণা সংস্কার এর ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। সংস্কার বলতে বোঝায় শুদ্ধিকরণ, পরিশোধন, সংশোধন, উৎকর্ষসাধন, উন্নতিবিধান, সৌন্দর্যবিধান ইত্যাদি। সংস্কৃতি মানে জীবন ও সমাজের শুদ্ধিকরণ, পরিশোধান, উৎকর্ষসাধন, উনইতবিধান, সৌন্দর্যবিধান। ইংরেজি Culture এর সম্পর্ক আছে Cultivation এর সঙ্গে। এই দুটি শব্দের অর্থও সংস্কৃতি আর সংস্কার এর অর্থের মত। জার্মান Culture শব্দও একই ধরণের অর্থ বহন করে। কৃষ্টি শব্দটিও একই অর্থের বাহক। কৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক আছে কৃষির বা চাষাবাদের।
এজন্য বলা হয় মানুষই সংস্কৃতির বাহক ও সাধক। শুধুমাত্র মানুষই পারে নিজের ও নিজের চারপাশের সংস্কার সাধন করতে। মানুষ ক্রমাগত তার পরিবেশের পরিবর্তন ঘটাতে চায়। চায় বিনির্মাণ করতে, পরিশীলিত করতে। তাই সাংস্কৃতিক অধিকার একমাত্র মানুষের রয়েছে, অন্য প্রাণীর নেই। মানুষ যতদিন পর্যন্ত বিবর্তনপ্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে এসে নিজস্ব সাস্কৃতিক পরিচয় তৈরি করতে পারেনি, ততদিন পর্যন্ত অন্যপ্রাণীর সাথে তার পার্থক্য
ততোটা পরিলক্ষিত হত না। ব্যক্তিগত ও যৌথ প্রয়াস মানুষের জীবন ও পরিবেশের যে উৎকর্ষ সাধন করেছে, তার গতি নির্ধারিত হয়েছে মানুষের নিজের ইচ্ছায়। মানুষ যেভাবে নিজের জীবনকে তথা তার পরিবেশকে সমৃদ্ধ করতে চায় তাই তার সংস্কৃতি। ব্যক্তিগত আচরণ, জীবনযাত্রা, মনোভঙ্গি, আদর্শবোধ ইত্যাদির মধ্যে তার সাংস্কৃতিক উপলব্ধি ও প্রচেষ্টা নিহিত থাকে। শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবন নয়, সাংস্কৃতিক চেতনা রয়েছে সামাজিক, জাতীয়, রাষ্ট্রীয় জীবনেও।
দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলা সৃষ্টি মধ্য দিয়ে আর উন্নতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতি প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ তার সাংস্কৃতিক সামর্থ্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে।.... সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কে সম্পর্ক আছে রুচি, পছন্দ, দৃষ্টি, শ্রুতি, চিন্তাশক্তি, শ্রমশক্তি, সমাজবোধ, বিবেক-বুদ্ধি, আহার্য, ব্যবহার্য, পরিপার্শ্ব, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিচারক্ষমতা, গ্রহণ-বর্জন ও প্রয়াস-প্রচেষ্টার। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ও যূথের কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, আন্তরিন্দ্রিয় ও পরিবেশের সংস্কার, রূপান্তর ও নবজন্ম ঘটে। কোনো ব্যক্তির কিংবা জনগোষ্ঠীর উৎপাদনসামর্থ্য, সৃষ্টির সামর্থ্য, ন্যায়নিষ্ঠা, কল্যাণচেতনা, সত্যপ্রিয়তা, সৌন্দর্যবুদ্ধি এবং উন্নত ভবিষ্যত সৃষ্টির চিন্তা ও চেষ্টা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তির কিংবা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের একটি সহজ প্রবণতা হল সংস্কৃতির সংজ্ঞার সংকোচন ঘটানো। আমরা ব্যক্তিজীবনের চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ, রুচি, দর্শনগত কোন পরিশীলন না করেই শুধুমাত্র গান-বাজনা অর্থাৎ বিনোদনচর্চাকে সংস্কৃতির
পরাকাষ্ঠা বলে গণ্য করি। আমরা মনে করি দুলাইন সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারা বা নাটকে অভিনয় অর্থাৎ মঞ্চে নিজেকে প্রদর্শন করতে পারলেই সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করা হলো। এ সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন:
কেবল নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক, বিনোদন ইত্যাদিকেই সংস্কৃতি মনে করা ভুল। মানুষের সকল চিন্তা ও কর্ম এবং উৎপাদন ও সৃষ্টিই তার সংস্কৃতির বাহন। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটকও সংস্কৃতির অন্যতম বাহন মাত্র, সংস্কৃতি নয়। সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক উৎসব (Cultural festival), সাংস্কৃতিক দল (Cultural troop) ইত্যাদি কথার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির যে রূপ পকাশ পায় তা অনুভূতি-নির্ভর ভাসাভাসা আংশিক রূপ মাত্র- সমগ্র রূপ নয়। নাচ-গান ও শিল্প সাহিত্যের মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনি দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিন্তা ও চেষ্টা এবং ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক জীবনের সকল চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় ব্যক্তির ও সমষ্টির সংস্কৃতি। আত্মশক্তিকে সংগঠিত কর, বিদেশের ও অতীতের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করে ইতিহাসের গতি নির্ধারণের চিন্তা ও চেষ্টা আর ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ, কর্তব্য-অকর্তব্য ও সুন্দর-কুৎসিত ইত্যাদি বিচার করে ন্যায়, কল্যাণ, কর্তব্য ও সুন্দরকে অবলম্বন করে জীবন-যাপনের চিন্তা ও চেষ্টা ইত্যাদির মধ্যেই ব্যক্তির ও সমষ্টির সংস্কৃতিমানতা নিহিত থাকে। বলাই বাহুল্য, কোনো জাতির সংস্কৃতির অভিব্যক্তি ঘটে সেই জাতির কৃতি ও কীর্তির মধ্যেই।
একটি মাত্র প্রবন্ধে সংস্কৃতির সম্পূর্ণকে প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন। সংস্কৃতির যথার্থ সংজ্ঞাকে কোন বর্ণনা দিয়ে নয়, অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। কোন ব্যক্তিবিশেষের সংস্কৃতি যেমন তার সত্যিকার পরিচয়কে উদঘাটন করে, তেমনি জাতীয় সংস্কৃতি প্রকাশ করে জাতিগত মূল্যমানকে। আমরা জাতি হিসেবে কেমন তার পরিচয় লুকায়িত থাকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। বিদেশী সংস্কৃতি, দেশীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি ধুয়া তুলে এর সমাধান সম্ভব নয়। নিজের পরিচয় কোথায় লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে হবে নিজেকেই। আর সেই মাপে পরিশীলিত করতে হবে নিজেকে। এই আত্মপোলব্ধির অভাবে তৈরি হয় অন্তঃসারশূন্যতা। আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক আবুল কাশেম ফজলুল হক সংস্কৃতির এই সামগ্রিক ধারণাটিকে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছেন। দিগন্তের এক বিন্দুবৎ প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তুলেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

About Me

আমার ফটো
শিক্ষাজীবী। গ্রন্থপাঠ এবং ভ্রমণ আমার প্রিয় বিষয়।

শিশুদের বইয়ের ওয়েব সাইট

বইয়ের খোঁজ

আর্কাইভ