"পাশ্চাত্যে অবস্থানকালে এবং তৎপরবর্তীকলেও যখন তিনি স্বদেশে অবস্থান করছেন, এঁকেছেন এমন অনেক চিত্র যা একদিকে বিষয়-উপজীব্য ও রূপ-বৈশিষ্ট্যে স্বদেশানুগ হয়েও গড়ন-গঠন ও প্রকাশশৈলীতে পাশ্চাত্যের শিল্পাদর্শের অনুকূল অতি উন্নত মানসম্পন্ন সৃজনশিল্পের প্রমাণ। সেদিক থেকে এদেশের নিরীক্ষাধর্মী আধুনিক চিত্রশিল্প শাখারও তিনি পথ-প্রদর্শক; কারণ শুরুটা গুরু-আবেদিনের মাধ্যমে শুধু সম্পাদিত হয়েছিলো বললে ভুলই হবে, আসলে তাঁর ওই সমস্ত ছবি (যেমন 'পাইন্যার মা'), 'গুণটানা', 'রমণী-১', 'চিন্তা', 'স্নানশেষে', 'কলসী কাঁখে' ও 'কৃষক' প্রভৃতি একটা শক্তিসম্পন্ন শিল্পকর্মের স্ট্যান্ডার্ড উপস্থাপিত করেছিলো পরবর্তী প্রজন্মের চারুশিল্পকর্মীদের জন্য।....... জয়নুল আবেদীন চেয়েছিলেন মাতৃভূমিতে চারুশিল্পীদের অংশগ্রহণ ও কর্মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে একটি উন্নত শিল্পীসমাজ গড়ে উঠুক। শিল্পীরা ছবি আঁকবে, শিল্পচর্চা করবে আর তার মাধ্যমেই এমন সুন্দর এক পরিবেশ তারা সৃষ্টি করবে যা এদেশের শিল্পকলা ও সংস্কৃতির বিকাশ-অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।"
আর্ট কলেজের শিক্ষক জয়নুল আবেদীন কিভাবে শিল্পাচার্য হয়ে উঠলেন তার কাহিনী মতলুব আলী স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন তাঁর 'আমাদের জয়নুল' (১৯৮৫) গ্রন্থভুক্ত 'শিল্পী থেকে শিল্পাচার্য' অধ্যায়ে। একথা তিনি নিজেই প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছেন। বিস্তারিত উদ্ধৃত করছি:-
'একদিন আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ঠিক করলো যে, তারা তাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের নামের মাধ্যমে সে বছরের বার্ষিক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবে। তাই করাও হলো- তার সম্মানে কয়েকটি ছত্র কবিতার মতো লিখে, তার শেষে "জয়নুল আবেদিনকে আমরা স্মরণ করছি এই শুভ উদ্বোধনে" এই কথাগুলি প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ছোট্ট পুস্তিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়ে দর্শকদের বিতরণ করে তারা প্রদর্শনীর দরজা খুলে দিলো। আর ওই লেখাটায় তাঁর নামের সামনে ছাত্ররা বুদ্ধি করে জুড়ে দিয়েছে নতুন একটি সম্মানজনক শব্দ: "শিল্পাচার্য"। তা অতিথি-দর্শকদের উদ্দেশে মাইকেও ঘোষণা করা হলো। 'আচার্য' অর্থ হচ্ছে শিক্ষক বা শিক্ষার গুরু, 'শিল্প' শব্দের সাথে আচার্য যোগ করে হলো 'শিল্পাচার্য'। আর জয়নুলতো শিল্প-শিক্ষা বা ছবি আঁকা শিক্ষার গুরুই। এখন 'শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন' এই নাম ছড়িয়ে পড়লো মুখে মুখে, ছাপানো হলো পত্র-পত্রিকায়। শেষটায় এমন হলো যে, শিল্পাচার্য বলতেই আমরা বুঝলাম জয়নুলের নাম।'কিন্তু জয়নুল আবেদীনকে এত শুধুমাত্র ছাতদের দ্বারা সম্মানিত করার প্রয়োজন পড়লো কেন? স্বাভাবিক চিন্তায় এরূপ ভাবনা আসতেই পারে। তার উত্তরও রয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধটিতে। মতলুব আলীর ভাষায়:-
বর্তমান নিবন্ধকারের জয়নুল-জীবনী বিষয়ক 'আমাদের জয়নুল' (১৯৮৫) গ্রন্থভুক্ত 'শিল্পী থেকে শিল্পাচার্য' অধ্যায়ের উদ্ধৃত কথাগুলি আমার এ-রচনার শিরোনামের সাথে ঘনিষ্ঠ- সে কারণে হুবহু উপস্থাপন করা গেলো। জয়নুল আবেদিনের শিল্পী ও ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ওই ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৬৭ সালে ঠিক যে-সময় ঢাকার আর্ট কলেজ পরিচয়ে সুবিদিত সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৮/১৯ বছর শিক্ষকতায় নিবেদিত থেকে ও প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অনিবার্য পরিস্থিতিতে ক্ষোভ-অভিমানের বশবর্তী হয়ে তিনি তাঁর পিতার মতোই স্বেচ্ছায় সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। নানাভাবে নানাদিক থেকে শত চেষ্টা ও অনুরোধ-আবেদন করেও তাঁকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠিত ওই চারুশিল্প শিক্ষায়তনে। শেষে উপায়ান্তর না দেখে মহান গুরুর প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদানের পরিকল্পনা নিয়ে চারুকলার তৎকালীন শিক্ষার্থীরা তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই 'শিল্পাচার্য' উপাধিতে ভূষিত করেছিলো।
জয়নুল আবেদিনের শিল্পাচার্য হওয়ার ঘটনাটি অনুঘটক পত্রিকার প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয় নাই। তবে আন্দাজ করা যায়, কর্তৃপক্ষের সাথে নীতিগত বিষয়ে হয়তো কোন মতদ্বৈধতা হয়েছিলো। ঠিক কত তারিখে ছাত্ররা সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো সেটা উল্লেখ থাকলে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর স্বরূপ বোঝা যেত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন