বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

বিদ্যাসাগরের সমাজ চিন্তা

শিক্ষাবার্তা পত্রিকার আগস্ট ২০০৮ সংখ্যায় বেশ কিছু প্রয়োজনীয় রচনা রয়েছে। আমি প্রয়োজনীয় বলছি এজন্য যে রচনাগুলো গুণগত ও উপাদানগত দিক থেকে বারবার পড়ার মতো ও পড়ে কিছু শেখার মত। প্রধানতম রচনাগুলো হল:
  • বার্ট্রাণ্ড রাসেলের শিক্ষা দর্শন - আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া
  • আধুনিক শিক্ষা ও ডিরোজিও - ড. সফিউদ্দিন আহম
  • বিদ্যাসাগরের সমাজ-চিন্তা - মো. সহীদুর রহমান
  • আলোকচিত্রে বঙ্গবন্ধু: ফিরে দেখা - জাহাঙ্গীর সেলিম
  • মূল্যবোধ - দীনেশ মণ্ডল
  • বাংলা ভাষার গৌরব ও অতুল প্রসাদ সেন - এম এ আজিজ মিয়া
  • দু'জন খ্যাতিমান মহিলা দার্শনিক - আব্দুস সালাম
  • বালাই, বালাইনাশক, আমাদের পরিবেশ ও জীবন - মফিজুল ইসলাম
এই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান লেখাগুলির মধ্যে আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে বিদ্যাসাগরের সমাজ-চিন্তা প্রবন্ধটি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সময়ের চাইতে অনেক বেশি অগ্রসর মানসিকতার।

তিনি যে সমাজে ও সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল সত্যিকার অর্থেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, ক্ষয়ে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া এক সমাজ। সেযুগের কি হিন্দু, কি মুসলমান কারও চিন্তারাজ্যে ভবিষ্যত পৃথিবীর স্বপ্ন ছিল না। সমাজ সম্পর্কে কোন সচেতনতা ছিল না। ব্রিটিশরা এদেশের অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। কিন্তু তারা আমাদের সাহিত্য- সংস্কৃতিতে যে জোয়ারের সৃষ্টি করেছে, যে নতুন যুগের ঢেউ সৃষ্টি করেছে, তা কালের ইতিহাসে চিরঅক্ষয় হয়ে থাকবে। তাদের শিক্ষার ফলে বাঙালির মননে জেগেছে নতুন স্বপ্ন। তারা বুঝতে পেরেছে আগামী পৃথিবীর স্বরূপ। এই আধুনিকতাকে যারা ধারণ ও লালন করতে পেরেছেন, তাদের পূর্বসুরী হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগরের সমাজ-চিন্তাশীর্ষক প্রবন্ধটি নিয়মিতভাবে শিক্ষাবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর লেখক মো. সহীদুর রহমান এর আলোচনায় আমি যাচ্ছিনা। সেই ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি শুধু বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যে কয়েকটি উদ্ধৃতি প্রবন্ধমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা পুনরায় প্রকাশ করছি।
দেবী প্রসন্ন রায় চৌধুরী লিখেছেন, "একদিন কথায় কথায় বিদ্যাসাগর মহাশয়, মহারাণী স্বর্ণময়ী ও তারক প্রামাণিকের নাম উল্লেখ করিয়া আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, ' এদেশে কেবল এই দুটি মানুষ আছে, আর সব পশু। পশুরাও নিজেদের লইয়া ব্যস্ত, ইহারাও তাই। কত ধনী এ দেশে আছে, কিন্তু একবেলা দরিদ্রকে একমুষ্টি খাইতে দেয়, এমন লোক নাই।' এই কথা বলিতে বলিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কণ্ঠ রূদ্ধ হইল, অবিরলধারায় চক্ষের জল পড়িতে লাগিল, আবার রুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন, 'এদেশের গতি কি ফিরিবে? হায়, তাহাদিগকে আমরা পশু তুল্য জ্ঞান করি, মানুষের ন্যায় জ্ঞান করিলে হয়ত আমাদের দ্বারা তাহাদের কিছু উপকার হইত। আপনারা চেষ্টা করুন, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, এদশের দরিদ্রদিগের গতি ফিরিবে না, তাদের মা বাপ নাই।' এইরূপ সহৃদয়তার কথা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট অনেকবার শুনিয়াছি। শুনিয়া বিমোহিত চিত্তে ভাবিয়াছি- বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর, প্রেমের অবতার; - ভবিয়াছি, এই গুনেই তিনি সর্ব্বজন পুজ্য।"- মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা ১৯৯৭, পৃ: ৩৭৪

বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দয়ায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন-
I hope... that I shall.. him to go back to India and tell my countrymen that you are not only Vidyasagara but karunasagara also"
এই উদ্ধৃতিটি নেয়া হয়েছে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (সম্পাদিত), মধুসূদন-নাট্য গ্রন্থাবলী, ১ম সংস্করণ-১৯৬৯, পৃ:৮৬৪, আবুহেনা মোস্তফা কামাল, সার্ধ-শত বর্ষ পূর্তি স্মারক গ্রন্থ ১৯৭০, পৃ: ২৬১ থেকে।

ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা খবরের কাগজগুলোর চরিত্র দেখে বিরক্ত হয়ে এক সময় একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। এর নাম 'সোমপ্রকাশ'
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আর এক কীর্তি 'সোমপ্রকাশ'। বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিতেন - যে সকল বাংলা কাগজ ছিল তাহাতে নানা রকম খবর দিত: ভালো খবর থাকিত, মন্দ খবরও থাকিত। লোকের কুৎসা করিলে কাগজের পসার বাড়িত, অনেক সময় কুৎসা করিয়া তাহারা পয়সাও রোজগার করিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিলেন, যদি কোন কাগজে ইংরেজির মতো রাজনীতি চর্চা করা যায়, তাহা হইলে বাংলা খবরের কাগজের চেহারা ফেরে। তাই কয়েকজন মিলিয়া 'সোমপ্রকাশ' বাহির করিলেন; - সোমবারে কাগজ বাহির হইতো বলিয়া নাম হইল 'সোমপ্রকাশ। - হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৯৯৭, ৩৪১।


এই প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ লিখেছেন:
নিজে সম্পাদক না হয়েও এবং সাংবাদিকের কাজ যথাযথ ভাবে না করেও, বাংলা সাংবাদিকতাকে ক্ষুদ্রতার গণ্ডি থেকে মুক্ত করে বিদ্যাসাগর বৃহত্তর ও সুস্থতর সমাজ-জীবনের দর্পণ স্বরূপ করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশে এই কারণে তাকে বলিষ্ঠ ও প্রগতিশীল সামাজিক রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অন্যতম প্রবর্তক ও পথপ্রদর্শক বলা যায়। - বিনয় ঘোষ, ১৯৯৩, ৩৩৮,৩৩৯-৪০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

About Me

আমার ফটো
শিক্ষাজীবী। গ্রন্থপাঠ এবং ভ্রমণ আমার প্রিয় বিষয়।

শিশুদের বইয়ের ওয়েব সাইট

বইয়ের খোঁজ

আর্কাইভ