আসলে বই কেনার অভ্যাসটাই আমাদের মধ্যে এখনও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। আবার সামর্থ্য থাকলেও বই কেনার আগ্রহ ও সদিচ্ছার অভাবটাও মাঝেমধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত 'বইকেনা' প্রবন্ধটি অনেকেরই পড়া আছে। এই প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যও কিন্তু বই পড়া ও বইকেনার অভ্যাসকে নিয়েই। এই বইকেনা প্রবন্ধটি তাঁর 'পঞ্চতন্ত্র' গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত। পঞ্চতন্ত্র বইয়ের বেশিরভাগ রচনা ত্রিশের দশকের সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে রচিত।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র ও শিক্ষক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষাতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বে পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। একাধিক বিদেশী ভাষা যেমন সংস্কৃত, হিন্দি, আরবি, ফারসি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন। তাকে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মতত্ত্ব ও তার তুলনামূলক বিচারে এই উপমহাদেশের স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম বলা হয়।
তাঁর পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটি অনেকগুলো প্রবন্ধের একটি সংকলন। গ্রন্থের সূচনায় লেখকের বয়ানে জানা যায়:-
এই পুস্তিকার অধিকাংশ লেখা রবিবারের 'বসুমতী' ও সাপ্তাহিক 'দেশ' পত্রিকায় বেরোয়। অনুজপ্রতিম শ্রীমান কানাই সরকার ও সুসাহিত্যিক শ্রীযুক্ত মনোজ বসু কেন যে এগুলো পুস্তিকাকারে প্রকাশ করার জন্য আমাকে বাধ্য করলেন সে কথা সুহৃদয় পাঠকেরা বিবেচনা করে দেখবেন।পঞ্চতন্ত্র বইটির সূচিপত্র বেশ সমৃদ্ধ। সবগুলো রচনাকে দুইপর্বে সাজানো হয়েছে।
সৈয়দ মুজতবা আলী, নয়াদিল্লী, আষাঢ়, ১৩৫৯
- প্রথম পর্ব ও
- দ্বিতীয় পর্ব
বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেছেন- সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতরে ডুব দেওয়া। যে যত বেশী ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার বেশী হয়।- বই কেনাকোনটা মহত্ত্বর? জ্ঞানার্জন নাকি ধনার্জন? এ বিষয়ক একটি সমস্যার সমাধান লেখক খুঁজে পেয়েছেন জনৈক আরব পণ্ডিতের লেখাতে।
পণ্ডিত লিখেছেন- 'ধনীরা বলে, পয়সা কামানো দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কর্ম কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, না, জ্ঞানার্জন সবচেয়ে শক্ত কাজ। এখন প্রশ্ন, কার দাবিটা ঠিক, ধনীর না জ্ঞানীর? আমি নিজে জ্ঞানে সন্ধানে ফিরি, কাজেই আমার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। তবে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, সেইটে আমি বিচক্ষণ জ্ঞানের চক্ষু-গোচর করতে চাই। ধনীর মেহন্নতের ফল হল টাকা। সে ফল যদি কেউ জ্ঞানীর হাতে তুলে দেয়, তবে তিনি সেটা পরমানন্দে কাজে লাগান, এবং শুধু তাই নয়, অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, ঢের উত্তম পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানচর্চার ফল সঞ্চিত থাকে পুস্তকরাজিতে এবং সে ফল ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানে না।- বই পড়তে পারে না।'- বই কেনাআরব পণ্ডিতের বক্তব্য শেষ হয়েছে এই বলে যে 'অতএব সপ্রমাণ হল জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর।'
মুজতবা আলী এই গল্পের উপসংহারে বলেছেন -"তাই প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক যোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে।'- বই কেনা
'আহারাদি' প্রবন্ধটিতে খাবারের আন্তর্জাতিক রূপ যে কত বৈচিত্র্যময় তার একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা পাওয়া যায়। এখান থেকে কয়েকটা খাবারের দেশিবিদেশী নাম জেনে নেই।
- আমাদের দেশের মাংশের ঝোল এবং প্যারিসের রেস্তোরাগুলোতে পরিবেশিত 'হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ' এর মধ্যে মূলগত কোন পার্থক্য নেই।
- 'ইতালিয়ান রিসেত্তো' মূলত ভারতীয় পোলাও মাংসের মতই।
কাইরোতে (কায়রো) খেলেন মিশরী রান্না। চাক্তি চাক্তি মাংস খেতে দিল, মধ্যিখানে ছ্যাঁদা। দাঁতের তলায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বটে, কিন্তু সোওয়াদ খাসা। খাচ্ছেন আর ভাবছেন বস্তুটা কি, কিন্তু কোন হদিস পাচ্ছেন না। হঠাৎ মনে পড়ে যাবে, খেয়েছি বটে আমজাদিয়ায় এই রকম ধারা জিনিস- শিক কাবাব তার নাম। তবে মসলা দেবার বেলায় কঞ্জুসী করেছে বলে ঠিক শিক কাবাবের সুখটা পেলেন না।
একই রান্না বিভিন্ন দেশে গিয়ে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন নাম গ্রহণ করেছে। মানুষের রুচি, অভ্যাস ছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি প্রভাব এর অন্যতম কারণ। ইতিহাস পাঠ করতে গিয়ে এর সন্ধান মেলে। তুর্কি ও পাঠানরা যখন ভারত জয় করে, তখন ভারতের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের মানুষেরা নিরামিষভোজী ছিল। তুর্কিদের প্রভাবে তারা মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়। তুর্কিরাও পূর্বে মাংসের সাথে মসলা মেশাতে জানতো না। ভারতীয়দের প্রভাবে তারাও মশলা খাওয়া শুরু করে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী রান্নার সাথে ভারতীয় মসলার মিশ্রণে যে অসাধারণ রান্নার আবিষ্কার হল, তারই নাম মোগলাই রান্না। মোগলাই রান্নার ঘ্রাণ আস্তে আস্তে সারা ভারতকে ছেয়ে ফেলেছে। এই তুর্কিরা পরে যখন বল্কান অঞ্চল জয় করে হাঙ্গেরি পার হয়ে ভিয়েনাতে গিয়ে হাজির হয়, তখন মোগলাই মাংসের ঝোল পরিবর্তিত হয়ে 'হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ' নাম ধারণ করল। মিশর ও তুর্কিদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ভেনিসের মানুষ 'মিনসটমীটের' পোলাও বা 'রিসোত্তো' বানাতে শিখে ফেলল। গ্রিস তুরস্কের অধিকারভুক্ত ছিল বলে গ্রিসের রান্নাতেও মশলার যথেষ্ঠ ব্যবহার রয়েছে।
ভোজনবিলাসী মানুষ ছিলেন মুজতবা আলী। খাদ্যরসিকদের প্রতি তার যে ভালোবাসা, তা থেকে তিনি মন্তব্য করেছেন:-
পৃথিবীতে দ্বিতীয় উচ্চাঙ্গের রান্না হয় প্যারিসে কিন্তু মশলা অতি কম, যদিও রান্না ইংরেজী রান্নার চেয়ে ঢের ঢের বেশী। এককালে তামাম ইয়োরোপে ফ্রান্সের নকল করত, তাই বল্কান গ্রীসেও প্যারিসী রান্না পাবেন। গ্রীস উভয় রান্নার সঙ্গমস্থল। বাকি জীবনটা যদি উত্তম আহারাদি করে কাটাতে চান, তবে আস্তানা গাড়ুন গ্রীসে (দেশটাও বেজায় সস্তা)। লাঞ্চ, ডিনার, সাপার খাবেন ফরাসী মোগলাই এবং ঘরোয়া গ্রীক কায়দায়।নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে নিয়ে তার লেখা নেতাজী প্রবন্ধ থেকে দুটো অংশ উদ্ধৃত করি। সেকালের অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটা বেশ প্রকট ছিল। পরস্পরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ এত বেশি ছিল যে শেষ পর্যন্ত ধর্মের নামে একটি অখণ্ড দেশ একাধিক ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বেশিরভাগ নেতাদের মধ্যেই কোন না কোন ধর্মের প্রতি সহানুভূতি ছিল বা তারা কোন একটি ধর্মাবলম্বী মানুষদের পক্ষে কথা বলতেন। সেই ধর্মের মানুষেরাই শুধু তাকে সমর্থন করত। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র।
একদিকে যেমন দেখতে পাই, সুভাষচন্দ্র 'আজাদ হিন্দ' নামটি অনায়াসে সর্বজনপ্রিয় করে তুললেন, অন্যদিকে দেখি, কৃতজ্ঞ মুসলমানেরা তাঁকে 'নেতাজী' নাম দিয়ে হৃদয়ে তুলে নিয়েছে- 'কাইদ-ই-আকবর' বা ঐ জাতীয় কোনো দুরূহ আরবী খেতাব তাঁকে দেবার প্রয়োজন তারা বোধ করে নি।হিন্দি-উর্দু ভাষা নিয়ে সে সময়ের রাজনৈতিক নেতারা সবসময় বিচলিত ছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের সে জাতীয় কোন সমস্যা ছিল না। মুজতবা আলীর ভাষায়-
রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি যে মহাত্মার থাকে, দেশকে সত্যই যিনি প্রাণ-মন সর্বচৈতন্য সর্বানুভূতি দিয়ে ভালবাসেন, সাম্প্রদায়িক কলহের বহু উর্দ্ধে নির্দ্বন্দ্ব পুণ্যলোকে যিনি অহরহ বিরাজ করেন, যে মহাপুরুষ দেশের অখণ্ড সত্যরূপ ঋষির মত দর্শন করেছেন, বাক্যব্রহ্ম তাঁর ওষ্ঠাগ্রে বিরাজ করেন। তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেন, সে-ভাষা সত্যের ভাষা, ন্যায়ের ভাষা, প্রেমের ভাষা। সে-ভাষা শুদ্ধ হিন্দী অপেক্ষাও বিশুদ্ধ হিন্দী, শুদ্ধ উর্দু অপেক্ষাও বিশুদ্ধ উর্দু। সে ভাষা তাঁর নিজস্ব ভাষা।সুভাষচন্দ্র দেশের সমস্যাটিকে এমনভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন যে, সাম্প্রদায়িক তুচ্ছতাকে মানুষ মোটেও আমলে নেয়নি।
আমার মনে হয়, সুভাষচন্দ্র এমন এক বৃহত্তর জাজ্বল্যমান আদর্শ জনগণের সম্মুখে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন, এবং তাঁর চেয়েও বড় কথা, এমন এক সর্বজনগ্রহণীয় বীরজনকাম্য পন্থা দেখাতে পেরেছিলেন যে, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি শিখ সকলেই সাম্প্রদায়িক স্বার্থের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদান করেছিলেন। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই, সুভাষচন্দ্র বলছেন, 'আগুন লেগেছে, চল আগুন নেভাই, এই আমার হাতে জল। তোমরাও জল নিয়ে এসো।' সুভাষচন্দ্র কিন্তু এ কথা বলছেন না, আগুন নেভাতে হলে হিন্দু-মুসলমানকে প্রথমে এক হতে হবে, তারপর আগুন নেভানো হবে।সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র বইটি প্রকাশ করেছে স্টুডেন্ট ওয়েজ। এর প্রিন্টার্স লাইনে প্রকাশকাল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই। অন্তত: প্রথম প্রকাশ কাল উল্লেখ করা উচিত ছিল। এখানে লেখা আছে 'এস.ওয়েজ দ্বিতীয় সংস্করণ বৈশাখ ১৪১৫ বঙ্গাব্দ'। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল এস. ওয়েজের প্রথম সংস্করণ কত সালে হয়েছিল তা বইয়ের কোথাও খুঁজে পেলাম না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন