শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৮

মেসেদিনী

মুজতবা আলীর 'পঞ্চতন্ত্র' বই থেকে কিছু মজার ঘটনা পূর্বের দুটি পোস্টে (পোস্ট এক এবং পোস্ট দুই) লিখেছিলাম। আজ একই বই থেকে আরেকটি কাহিনী পড়বো। মেসেদিনী শীর্ষক রচনাটিতে লেখক সংক্ষেপে দেশপ্রেম, মাতৃভাষার প্রতি ভক্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কে অনুকরণীয় উদাহরণ প্রকাশ করেছেন।

মুজতবা আলী একবার ভারতবর্ষে ফিরছিলেন। জাহাজে অনেক যাত্রীর মধ্যে একজন মহিলা যিনি বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই) আসছিলেন। লন্ডনে তার স্বামী ব্যবসা জমিয়ে বসেছে। ভারতে মেয়ের বাড়িতে আসছেন। ইংল্যান্ডে বাড়ি বানাবার পূর্বে তারা ইরানে থাকতেন। ইরানের মেসেদে তাদের ব্যবসা ছিল। লন্ডনে আটবছর বাস করেও মহিলা একবর্ণ ইংরেজি শেখেননি। যে সময়ের কাহিনী (৩০ এর দশক) সে সময়ে ইরানে ইহুদীরাও যে বাস করতো তার একটি চিত্র এই মেসেদিনী রচনাটি থেকে জানতে পারলাম।

মহিলা ইংরেজি না জানার কারণে কারও সাথে কথা বলতেন না। মুজতবা আলী ফার্সী ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলতেন। তাকে পেয়ে মহিলা হাঁফ ছেড়েছিলেন। জাহাজ ছেড়ে আসার পর থেকে কারও সাথে কথা বলতে না পেরে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। ইংরেজি শেখেননি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন:-
লণ্ডনে তো আমি ইচ্ছে করে যাই নি। আমার স্বামী মেশেদে সর্বস্বান্ত হয়ে লণ্ডন গেলেন তাঁর কাকার কাছে। আমরা ইহুদি, জানেন তো, আমরা ব্যবসা করি দুনিয়ার সর্বত্র। সেখানে ওঁর দু'পয়সা হয়েছে, কিন্তু আমাদ্বারা আর ইংরিজি শেখা হল না। ইরানী ইহুদিরা যে দু'চারজন লণ্ডনে আছেন, তাঁদের সঙ্গেই মেলামেশা করি, কথাবার্তা কই। তবে হাট করতে গিয়ে "গ্রীন পীজ, কলি-ফ্লাওয়ার, ট্যাপেল, ত্রাপেন্স-হে পেনি" বলতে পারি, ব্যস।
স্বামী লণ্ডনে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দিনে দিনে তার ব্যবসার প্রসার বাড়ছে। তার আর লণ্ডন ছাড়ার ইচ্ছে নেই। মহিলা কিন্তু লণ্ডন শহরটাকে মোটেও ভালবাসতে পারছেন না। মেসেদ শহরের স্মৃতি তাকে প্রায়ই কাতর করে তোলে। জন্মভূমির জন্য তার আকুলতা তার বক্তব্যের প্রত্যেক লাইনে স্পষ্ট।

লণ্ডন সাফসুৎরো জায়গা, বিজলি বাতি, জলের কল, খাওয়া-দাওয়া, থিয়েটার সিনেমা সবই ভালো- কোথায় লাগে তার কাছে বুড়ো গরীব মেশেদ? তবু যদি জানতুম একদিন সেই মেশেদে ফিরে যেতে পারবো, তাহলেও না হয় লণ্ডনটার সঙ্গে পরিচয় করার চেষ্টা করতুম, কিন্তু যখনই ভাবি ঐ শহরে আমাকে একদিন মরতে হবে, আমার হাড় ক'খানা বাপ-পিতামোর হাড়ের কাছে জায়গা পাবে না, তখন যেন সমস্ত শহরটা আমার দুশমন, আমার জল্লাদ বলে মনে হয়।
জাহাজে কয়েকদিন সঙ্গ পেয়ে (আসলে একমাত্র তার সাথেই মাতৃভাষায় কথা বলতে পেরেছেন বলে) মহিলা মুজতবা আলীর উপর খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছিলেন। বোম্বে পৌছে লেখককে আর হোটেলে উঠতে দেননি। মেয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। জাহাজ ঘাটে পৌছলে, কাস্টমস এর আনুষ্ঠানিকতা শেষে মহিলা মুজতবা আলীকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেয়ে ও জামাই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন:
এই আমার বন্ধু দিল-জানের দোস্ত, আমার সঙ্গে ফার্সী কথা কয়েছে, ফুর্তি-ফার্তি হৈ-হল্লা ছেড়ে দিয়ে। মেয়ে যতই জিজ্ঞেস করে, জাহাজে ছিলে কি রকম, খেলে কি, বাবা কি রকম আছেন, কে বা শোনে কার কথা, সত্য-সত্যই জাহাজে যেন 'সমুদ্রে রোদন।' তিনি বারবার বলেন, 'বুঝলি, নয়মি, এঁকে আচ্ছাসে খাইয়ে দিতে হবে। পোলাওর সব মালমশলা আছে তো বাড়িতে?'
লেখক তাদের সাথে তিন দিন ছিলেন। এই তিন দিন কেমন ছিলেন, তা লেখকের জবানীতে শোনা যাক:
সে তিন দিন কি রকম ছিলুম? মাছ যে রকম জলে থাকে। ভুল বলা হল: মাছকে যদি শুধান, 'কি রকম আছে?' তবে সে বলবে, 'সৈয়দের ব্যাটা যে রকম ইহুদী পরিবারে ছিল'।

1 টি মন্তব্য:

আব্দুল মোমেন বলেছেন...

ধন্যবাদ মূল্যবান তথ্য জানানোর জন্য। আমি সৈয়দ মুজতবা আলী-র লেখার ভক্ত। তার লেখা বই ই-বুক আকারে কোথায় পাওয়া যাবে দয়া করে জানাবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

About Me

আমার ফটো
শিক্ষাজীবী। গ্রন্থপাঠ এবং ভ্রমণ আমার প্রিয় বিষয়।

শিশুদের বইয়ের ওয়েব সাইট

বইয়ের খোঁজ

আর্কাইভ