সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০০৮

ক্ষুদিরামের ফাঁসির শতবর্ষ

আজ ১১ আগস্ট, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবি ক্ষুধিরামের ফাঁসির শতবর্ষ পূরণ হল। আজকের প্রথম আলো পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ পড়লাম। ভাল লাগল। বারবার পড়ার জন্য সম্পূর্ণ লেখাটি এখানে তুলে দিলাম।

ক্ষুদিরামের ফাঁসির শতবর্ষ
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের যেসব সত্য কাহিনী লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে কিংবদন্তির রূপ নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলো ভগত সিং, সুর্যসেন, বিনয়-বাদল-দিনেশ ও ক্ষুদিরামের কাহিনী। এর মধ্যে ক্ষুদিরামের কাহিনী অধিক মাত্রায় লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তার কারণ সম্ভবত ক্ষুদিরামের বয়স ও দুঃসাহসিকতা।
১৮৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে ক্ষুদিরাম বসু জন্নগ্রহণ করেন। যখন তাঁর বয়স ছয় বছর, তখন তাঁর মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী মৃত্যুবরণ করেন। এবং মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসুও মৃত্যুবরণ করেন। এরপর এই অনাথ ক্ষুদিরামের আশ্রয় জোটে জ্যেষ্ঠ বোনের গৃহে। এই বোন সাধ্যমতো স্েমহ ও মমতা দিয়ে তাঁকে প্রতিপালন করেছেন।


প্রাথমিক অবস্থায় গ্রামের স্কুলেই ক্ষুদিরামের পড়ালেখা শুরু হয়। এরপর তমলুকের হ্যামিলটন স্কুল এবং মেদিনিপুর কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। মেধাবী ও দুরন্ত কিশোর ক্ষুদিরাম ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পড়ার পাট চুকিয়ে দেন। লেখাপড়ায় অমনোযোগী ক্ষুদিরামের ঝোঁক ছিল দুঃসাহসিক কর্মকান্ডে। আর এলাকার যেকোনো অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং সমবয়সীদের সংঘবদ্ধ করে প্রতিরোধের চেষ্টা করার মধ্যে ছিল ক্ষুদিরামে আনন্দ।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ইংরেজ সরকার বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। যাকে বঙ্গভঙ্গ বলা হয়। ঐক্যবদ্ধ বাংলাকে ইংরেজের পক্ষে একটি বিপজ্জনক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাংলাকে বিভক্ত করে ইংরেজ সরকার। ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয় কলকাতার মানুষ। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে জন্ন নেয় স্বদেশি আন্দোলন। যে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে এসে দাঁড়ায় ছাত্ররা। বিশেষ করে স্কুলের কিশোরেরা। আর এই দুই আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয় অহিংস সংগ্রাম যেমন পরিচালিত হয়, তেমনি সহিংস কর্মকান্ডভিত্তিক গোপন সংগঠনেরও জন্ন হয়।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। এ বছর ক্ষুদিরাম সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন। এখানে তাঁর শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা হয়। এখানে পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। এই গুপ্ত সংগঠনের কর্মসুচির অংশ হিসেবে ক্ষুদিরাম ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকান্ডে তাঁর সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
১৯০৬ সালের মার্চ মাসে মেদিনিপুরে আয়োজিত হয় কৃষি ও শিল্পমেলা। এ মেলায় সমবেত মানুষের মধ্যে ইংরেজবিরোধী ইশতেহার বিলি করতেন ক্ষুদিরাম। এখানে ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। এই তাঁর প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া। তবে বুদ্ধি খাটিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। এ বছরের এপ্রিল মাসে লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ক্ষুদিরাম। তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আদালত তাঁকে দোষী হিসেবে দন্ডিত করেন। তবে অল্প বয়স বিবেচনায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯০৭ সালে ক্ষুদিরাম হাটগাছায় ডাক বিভাগের থলি লুট করেন। এ ঘটনায় তাঁর অসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ বছরের ৬ ডিসেম্বর ক্ষুদিরাম নারায়ণগড় রেলস্টেশনের কাছে বঙ্গের ছোট লাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা হামলা করেন। এ সময় কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। তিনি বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয়দের ঘৃণা করতেন। সুযোগ পেলেই তিনি ভারতীয়দের দন্ড দিতেন। বস্তুত কিংসফোর্ড এদেশীয়দের কাছে মূর্তিমান ত্রাসে পরিণত হন।
গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’ ১৯০৮ সালে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। কিংসফোর্ডকে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুকে। দুই তরুণ যখন কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে যান, তখন কিংসফোর্ড সেশন জজ হিসেবে বদলি হন মুজাফ্ফরপুরে। ৩০ এপ্রিল প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে রাতের অন্ধকারে অ্যাম্বুশ করে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো একটি গাড়ি আসে। তাঁরা ওই গাড়িকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওই গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন ইংরেজ এক মহিলা ও তাঁর মেয়ে। তাঁরা বোমার আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। বোমা হামলার পর ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল পালিয়ে যান।
ওই রাতে পুলিশ সব স্থানে তল্লাশি করে। অবশেষে ওয়ানি রেলস্টেশনে ক্ষুদিরাম অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ক্ষুদিরাম বোমা হামলার সব দায় নিজের কাঁধে নেন। সহযোগীদের কথা বলেন না। ফলে বোমা হামলা ও দুজনকে হত্যার অপরাধে ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ হয়।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ক্ষুদিরাম বসুকে রাখা হয় মুজাফ্ফরপুর কারাগারে। সেখানে যারা তাঁকে দেখেছে তারা বলেছে, কারাগারে ক্ষুদিরাম খুবই স্বাভাবিক ছিলেন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট খুব ভোরে তাঁকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্ষুদিরাম বসু অসম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে হেঁটে, হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ান এবং ভয়শুন্যচিত্তে ফাঁসির রশি গলায় পরেন।
ক্ষুদিরাম বসুর অসম সাহসিকতার কথা, আত্মত্যাগের কথা সে সময় ব্যাপকভাবে লোকমুখে প্রচারিত হয়। তাঁর কথা শুনে দেশবাসী অনুপ্রাণিত হয়। ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম আরও বেগবান হয়। বিপ্লবী তরুণ ক্ষুদিরাম বসুর জীবনকাহিনী ও আত্মদানের গৌরবগাথা নিয়ে নানা রকম সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হচ্ছে গান। তার ফাঁসির প্রায় তিন মাস পর অখ্যাত গীতিকার পরেশচন্দ্র ধর লেখেন বিখ্যাত গান−
‘একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি
আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।
আবার অনেক বছর পরে
জন্ন নেব ঘরে ঘরে মাগো
তখন চিনতে যদি না পারো মা দেখবে গলায় ফাঁসিু’ (মূল পান্ডুলিপি থেকে)।
আজ ক্ষুদিরামের ফাঁসির শতবর্ষ। এই শতবর্ষে আমাদের প্রিয় মাতৃভুমির প্রয়োজনে বারবার ক্ষুদিরামের জন্ন হয়েছে। যদি আমাদের মাতৃসম দেশ কখনো বিপন্ন হয়, তবে নিশ্চয়ই অসংখ্য ক্ষুদিরামের জন্ন হবে।

রতন সিদ্দিকী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

About Me

আমার ফটো
শিক্ষাজীবী। গ্রন্থপাঠ এবং ভ্রমণ আমার প্রিয় বিষয়।

শিশুদের বইয়ের ওয়েব সাইট

বইয়ের খোঁজ

আর্কাইভ