রবিবার, ২৯ জুন, ২০০৮

শিক্ষক : গুরু থেকে পেশাজীবী

২২ জুন ২০০৮ এর সমকাল পত্রিকায় শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বিষয়ে কাজী ফারুক আহমেদ এর একটি প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ পড়লাম। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শিক্ষকতার মান, শিক্ষকদের সমস্যা, সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ প্রবন্ধটিতে রয়েছে। আমার মনে হল লেখাটি বারবার পাঠ করার মতো একটি রচনা। তাই সমকাল পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারপূর্বক লেখাটি এখানে প্রকাশ করলাম।
শিক্ষক : গুরু থেকে পেশাজীবী

প্রাইভেট টিউশনি
কাজী ফারুক আহমেদ

শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরূপ সমালোচনা চলে আসছে। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে, তার প্রায় প্রত্যেকটিতে একই ভাষায় এর বিরোধিতা করা হয়েছে। তারপরও সরকারি-বেসরকারি স্কুলল-কলেজের শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ হয়নি। এখানে বলে রাখা ভালো, অনেকেই শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে ছাত্র ভর্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ছাত্রছাত্রীদের ‘গ্যারান্টি দিয়ে চুক্তিভিত্তিক’ ছকে বাঁধা পাঠদানকে এক করে দেখেন; যদিও এ দুয়ের মধ্যে মিল ও অমিল দুটিই আছে।

কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৭৪-এ বলা হয় : ‘জীবন ধারণের প্রয়োজন মেটাবার জন্য শিক্ষকদের অনেককে প্রাইভেট টিউশনি করতে হয়। এর ফলে একটা দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে এবং নিন্ম বেতনভুক মানুষকে স্বল্প কাজ, এমনকি অসদুপায় এবং পরিণামে জনগণের অশ্রদ্ধা প্রভৃতির দিকে পরিচালিত করে। বলাবাহুল্য, এ অবস্থায় শিক্ষকদের কাছে উন্নতমানের শিক্ষাদান প্রত্যাশা করা কঠিন। ফলে শিক্ষার মান অবনমিত হয় এবং সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জনচক্ষে হেয় হয়ে পড়ে।’


জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩-এর প্রতিবেদনে আছে : ‘শিক্ষকদের কাছে সমাজের চাহিদা অনেক। তবে তাদের বেতনভাতাদি অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত সমযোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের তুলনায় কম। সচ্ছল জীবনযাপনের তাগিদে অনেক শিক্ষক এখন নিজেদের দায়িত্বের প্রতি কম মনোযোগী হয়ে প্রাইভেট টিউশন এবং কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। অনেক অভিভাবক নিজেদের সন্তান-সন্ততির ভালো ফল লাভের উদ্দেশ্যে একাধিক গৃহশিক্ষক নিয়োজিত করছেন। এর ফলে হচ্ছে এই যে, শিক্ষা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে হয়তো কোনো কোনো শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রী এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে... বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।’

এডুকেশন ওয়াচের ২০০৭-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সরকারি কোষাগার থেকে অর্থায়ন উল্পুয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম। শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থায়নের অপ্রতুলতা পূরণ হয় অভিভাবকদের অর্থে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তা ৫৯ শতাংশ, আর মাধ্যমিক স্তরে ৭১ শতাংশ। গৃহশিক্ষকের পেছনে ব্যয় সর্বোচ্চ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ ছাত্রের এবং বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর জন্য গৃহশিক্ষক রাখতে হয়েছে।’

আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও আইএলও বিধান মোতাবেক একজন শ্রমজীবী-পেশাজীবীর বেতনভাতা এমন হওয়া উচিত যাতে তাকে বাড়তি বা খণ্ডকালীন পেশা গ্রহণ করতে না হয়। বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিতদের বেলায় সরকারের নীতিতে যে এর প্রতিফলন নেই, তা আজ অত্যন্ত স্পষ্ট। বেতনভাতা, মানসম্মান কোনোটাই আকর্ষণীয় না হওয়ায় শিক্ষকদের পেশা ত্যাগ অথবা পেশা পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত সেজন্যই সবচেয়ে বেশি। প্রধানত, যেসব কারণে এবং বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে একজন শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে এবং অভিভাবকও সেজন্য অর্থ ব্যয় করেন, তা হলো : ১. শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানকালে শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে তাল মেলাতে অপারগতা; ২. নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা সূচি শিক্ষার্থীর কাছে দুর্বোধ্য ও অবোধগম্য মনে হওয়া; ৩. শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি; ৪. নির্ধারিত বিষয় বা পাঠ্যক্রমে আকর্ষণীয়ভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপনে শিক্ষকের অক্ষমতা; ৫. পরীক্ষা, বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল লাভে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের অতি আগ্রহ।
আমাদের দেশে সব বিষয়ের শিক্ষকের প্রাইভেট টিউটর হিসেবে চাহিদা নেই। তাছাড়া শুধু সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকই প্রাইভেট পড়ান না। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও পড়ার খরচ জোগাড় করতে প্রাইভেট টিউশনি করে থাকেন। আজকাল ছাত্রীদেরও বাসায় গিয়ে টিউশনি করতে দেখা যায়। বর্তমানে বেকারত্ব ঘোচাতে কম ঝামেলা ও ঝুঁকিমুক্ত প্রাইভেট টিউশনিকে কেউ কেউ পেশা হিসেবেও গ্রহণ করছেন। ঢাকা মহানগর ও বিভাগীয় শহর ছাড়া বেশ কিছু জেলা শহরেও কিছু কিছু বিষয়ে প্রাইভেট টিউটরের কদর আছে। ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একচেটিয়া প্রাধান্য। প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়লে প্র্যাকটিক্যালে ভালো নম্বর পাওয়া যায়- এমন অভিযোগও বেশ পুরনো। কিন্তু বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে একশ্রেণীর অভিভাবককে সন্তানদের পালা করে সব বিষয়ের প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠাতে দেখা যায়। যাদের পয়সা বেশি, তারা বাড়িতেই প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু যেসব প্রাইভেট টিউটর বাসাবাড়িতে গিয়ে না পড়িয়ে নিজের বাসায় ব্যাচ খুলে প্রাইভেট পড়ান, অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের চাহিদা পূরণে সেখানেই ছুটে যান। প্রাইভেট টিউটরদের আয়-রোজগার বড় বড় শহরে ভালোই। প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ স্কুল-কলেজের বেতন থেকে কয়েকগুণ বেশি তো বটেই! গাজীপুরের কালিয়াকৈরের শিক্ষক সতীশ চন্দ্র সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের টিউশনি নিয়ে ১৭ মার্চ দৈনিক সমকালে লিখেছেন : ‘প্রাইভেট টিউশনি শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে- এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমি প্রায় ২০ বছর ধরে শিক্ষকতায় আছি। প্রতিদিন ৬টি বিষয়ে পাঠদান করি। বাসা ভাড়া দিই ৪ হাজার টাকা। বাচ্চা ছেলেটির জন্য গুঁড়ো দুধ কিনতে হয় মাসে ৩ হাজার টাকার। বেতনের ওপর নির্ভর করে কোনোভাবেই চলা সম্ভব নয়। কাজেই শখের বশে নয়, ধনী হওয়া বা উচ্চাশা নিয়েও নয়, শুধু বর্তমান প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউশনির দিকে ঝুঁকতে হয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাইভেট টিউশনি নিষিদ্ধ। সেখানে প্রত্যেক শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রাইভেট টিউশনি না করার অঙ্গীকারনামায় সই করে থাকেন। কারণ একটাই, পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভারতীয় মুদ্রায় ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা।

পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মানজনকভাবে জীবনযাপনের একটা নিশ্চয়তা পেলে এ দেশেও শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আইন করে প্রজ্ঞাপন জারির মারফত একটা অসন্তুষ্টি আর অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে না।’

দেশ অথবা বিদেশ যেখানেই প্রচলিত থাকুক, শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি শিক্ষকতার মর্যাদার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের দেশে তা শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষাপদ্ধতির অন্তর্নিহিত বিচ্যুতির বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষাকে মানব উন্নয়নের সোপান বিবেচনায় ও যুগোপযোগীকরণে ব্যর্থতা, অর্থ ও মানবসম্পদের বিশাল অপচয় এবং শিক্ষাদানে নিয়োজিতদের প্রতি উপেক্ষাসূচক দৃষ্টিভঙ্গির করুণ পরিণতি। দেশের স্বার্থেই এ অবস্থার আশু অবসান প্রয়োজন। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান ও গ্রহণই যেখানে কাম্য, সেখানে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকের নিজ গৃহে পাঠদান অথবা বিত্তশালীর গৃহে গিয়ে ‘জ্ঞান বিতরণ’ কোনোটাই সমর্থনযোগ্য নয়।

প্রতিকারের লক্ষ্যে ৭টি প্রস্তাব : শিক্ষকের প্রাইভেট টিউশনি তথা শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান নৈরাজ্যের একটি বিশেষ দিকের অবসানকল্পে জরুরিভাবে নিম্নোক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় : ১. স্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ মোতাবেক সমাজে শিক্ষকতা পেশার গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরতে সক্ষম এমন বেতনভাতা প্রদান এবং সমযোগ্যতাসম্পন্ন, অপরাপর পেশায় নিয়োজিতদের সঙ্গে তুলনায় শিক্ষকের বেতন অধিকতর সমতাযুক্তভাবে নির্ধারণ; ২. শিক্ষক সংগঠনগুলো ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষকদের জন্য তাদের পেশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ; ৩. পাঠদান পদ্ধতির অব্যাহত উন্নয়ন; ৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন, পরীক্ষাপদ্ধতির যুগোপযোগী সংস্কার ও পাবলিক পরীক্ষার ক্রমান্বয়ে বিলোপের উদ্যোগ গ্রহণ; ৫. শিক্ষকদের পাঠদান পর্যবেক্ষণ ও প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক মান উন্নীতকরণের লক্ষ্যে একটি প্রতিষ্ঠানে আকস্মিক একাডেমিক পরিদর্শন; ৬. শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের প্রশিক্ষণের কর্মসূচি গ্রহণ; ৭. শিক্ষকদের গবেষণাকর্মে উৎসাহিত করতে বিশেষ বৃত্তি প্রদান।

শিক্ষকতাকে অনেক মহান ব্রত মনে করলেও সময়ের বিবর্তনে আজ তা এক ভিন্নধর্মী পেশা। যেখানে শুধু ত্যাগ নয়, ভোগের স্পৃহাও উপস্থিত। শিক্ষকের সমান যোগ্যতার অধিকারী অন্য পেশার কারো থেকেই অর্থে, মর্যাদায়, পোশাক-পরিচ্ছদে তার (শিক্ষকের) স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ পরিবারের সদস্যরা তাকে পেছনে দেখতে রাজি নন! নিজেরাও কারো কাছ থেকে এক পা পেছনে থাকতে রাজি নন। বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের যে পরিবর্তন হয়েছে, শিক্ষক বা তার পরিবারও তার বাইরে নয়! যে বিবেচনায় শিক্ষক আর পুরনো দিনের ‘গুরু’ নন, পেশাজীবী। শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি করার বাস্তব কারণগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে প্রাপ্য মর্যাদার যথাযথ স্থানে বসানো সেজন্যই আজ বড় জরুরি। সংশ্লিষ্ট সবার উপলব্ধি করা দরকার যে, অনাহার-অর্ধাহারক্লিষ্ট শিক্ষক দিয়ে আর যাই হোক শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। তার মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ না করে শুধু তত্ত্বকথা, উপদেশ-নির্দেশ দিয়ে কোনো কাজ হবে না!
principalqfahmed@yahoo.com

লেখক : বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চেয়ারম্যান, ‘মানব-উন্নয়ন উদ্যোগ’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

About Me

আমার ফটো
শিক্ষাজীবী। গ্রন্থপাঠ এবং ভ্রমণ আমার প্রিয় বিষয়।

শিশুদের বইয়ের ওয়েব সাইট

বইয়ের খোঁজ

আর্কাইভ